সেদিন আমার চার বছরের মেয়ে একটি ছবি আমার হাতে দিয়ে বলল, 'আম্মু, বাবার পাশে ওই মেয়েটি কে?'
ছবিটা টুকরো টুকরো করে ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম। মেয়েটা একদম রাহাদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে। ঘনিষ্ঠ কেউ না হলে এতটা কাছে যাওয়া সম্ভব না।
রাহাদ প্রায় রাতেই ঘুম থেকে উঠে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ইদানীং এমনটা ঘন ঘন হচ্ছে। আজকাল এমনও হয়, রাতে ঘুম থেকে উঠে ফোন হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায়। সারা রাত শেষে ফজরের সময় হাই তুলতে তুলতে বিছানায় ঢলে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে টেনে তুলতে হয়। তড়িঘড়ি করে তৈরি হয়ে টলতে টলতে অফিসে যায়।
বিষয়টা আমার নজর না এড়ালেও আমি কিছু বলতে পারি না। যাকে এতটা ভালোবাসলাম। যে মানুষটাকে চোখ বুজে বিশ্বাস করে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে পালালাম। আজ তাকেই সন্দেহ করব?
কিন্তু না চাইতেও সন্দেহ করে বসি। মাঝে মাঝে মনে হয়, রাহাদ আর আমার নেই। মানুষ ভালোবাসার মানুষকেই তো সন্দেহ করে, তাই না? আমি নাহয় ভালোবেসে একটুখানি সন্দেহ করেই ফেললাম!
এদিকে রাহাদের পরিবর্তন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এতদিন সে রাত জেগে ফোনে কথা বলত। আজকাল রাত করে বাড়ি ফেরে। বারোটা, একটা কিংবা তারও অধিক। দেড়িতে ফেরার কারণ জানতে চাইলে সে ঠিকঠাক জবাব দেয় না। অফিসের দোহাই দিয়ে দায়সারা হয়ে বিছানায় ঢলে পড়ে। রাতের খাবারটুকুও খায় না। এদিকে আমি যে না খাওয়া! সে না খেলে আমি খাই কীভাবে?
সবচে' বড়ো ব্যাপার হলো, রাহাদ আমার চোখের দিকে তাকায় না। সকালে নাশতা করতে টেবিলে বসে আমাদের চোখাচোখি হত। কত খুশগল্প করেছি আমরা। বেশিদিন নয়, গত তিন মাস। তিন মাস আগেও সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। এ কয়েকটা দিনে সব পরিবর্তন হয়ে গেছে। রাহাদ কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেছে। নিজে থেকে কিছু বলে না। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলেও ঠিকঠাক জবাব দেয় না। হাঁ, হুঁ'তে চালিয়ে দেয়।
দ্বিতীয় বার ছবি পেলাম রাহাদের ডায়েরির ভেতর। যদিও পারসোন্যাল ডায়েরি। ওঁর ড্রয়ারে তালাবন্দি করা থাকে। আজ চাবিটা তালার সাথে ঝুলছিল দেখে খুলে ফেললাম। ড্রয়ার থেকে ডায়েরি হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা ওল্টাতেই একটা ছবি উড়ে উড়ে মাটিতে পড়ল৷ হাতে নিয়ে দেখলাম, রাহাদের সাথে সেই মেয়েটা। একদম কাছাকাছি। কোনো এক শপিং মলে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে ওঁরা। মেয়েটাকে রাহাদের এতটা কাছে দেখে গা জ্বলে উঠল। কিছুটা সময়ের জন্য পাগলের মতো হয়ে গেলাম। ওয়াড্রোবের উপরে থাকা কাচের জিনিসপত্র একে একে ভাঙতে শুরু করলাম। মাটিতে আছড়ে পড়ে ফ্লোরে ছড়িয়ে যায় কাচের টুকরো টুকরো অংশ। সেই টুকরো অংশ হাতে নিয়ে চোখের জল মুছে আবার ছুুঁড়ে মারি।
তরল কিছু একটা হাতে অনুভব করলাম। ডান হাত কেটে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত টপটপ করে ফ্লোরে পড়ছে। রক্ত দেখে স্তম্ভিত ফিরে পেলাম। একী করছি আমি? এটা তো আমার সাজানো সংসার। এই ঘর, এতসব আসবাবপত্র সব আমার কেনা। পুরো সংসার যত্ন করে সাজিয়ে শেষে কিনা নিজ হাতে ভেঙে ফেলছি!
তখনও রাহাদের প্রতি সম্পুর্ণ বিশ্বাস ছিল। আমি মন দিয়ে বিশ্বাস করতাম, সে আর যাই করুক, আমাকে কখনো ঠকাবে না। কী জানি, হয়তো এই আশাটুকুই বেঁচে থাকার মাধ্যম। সব মানুষ-ইতো আশায় বাঁচে। স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। আমার বেঁচে থাকা এখন রাহাদকে নিয়ে। আরো একজন আছে। মুসকান৷ আমার সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটা। তবে আমার কেন জানি মনে হয়, রাহাদ আমাকে ধোঁকা দিলে আমি বাঁচব না। মরে যাব। তাৎক্ষণিক মরে যাব। আমার মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে রাহাদ ছোটো বাচ্চাদের মতো কাঁদবে। তখন জানতে পারবে, কতটা ভালোবেসেছি তাকে।
নিচতলায় এক বৃদ্ধা মহিলা থাকেন। রওশন আরা না কী যেন নাম। তিনিই এ বাড়ির মালিক। ছেলে ক্যানাডায়। মেয়ে অস্ট্রেলিয়া। বাড়িতে তিনি একাই থাকেন। একদিন দুপুরবেলা তিনি দোতলায় এলেন। দরজায় দাঁড়িয়েই বললেন, 'ঝিনুক, শরীর কেমন তোমার?'
ভদ্রমহিলা গম্ভীর স্বভাবের মানুষ। প্রয়োজন ব্যতীত কথা বলেন না। আজ হঠাৎ শরীরের কথা জিজ্ঞেস করছেন যে!
আমি কৌতূহল দমিয়ে রেখে মৃদু হেসে বললাম, 'ভালো।'
'রাহাদের সাথে কী হয়েছে?'
'কই? কিছু হয়নি তো।'
'কাল রাতে জরুরি দরকারে বেরিয়েছিলাম। রাহাদকে একটা মেয়ের সাথে দেখলাম...'
পুরো কথা বলার আগেই আমি বললাম, 'হয়তো অফিসের কাজে বেরিয়েছে। রাহাদের অনেক মেয়ে কলিগ আছে। হয়তো তাদের মধ্যেই একজনকে দেখেছেন আপনি।'
'অফিসের কলিগের হাত ধরে কেউ হাঁটাচলা করে? শোনো ঝিনুক, আমি তোমাকে গত পাঁচ বছর ধরে দেখছি। অনেক কষ্টে দাঁড় করিয়েছো সংসারটা। এখন তোমাদের একটি মেয়েও আছে। সামান্য কারণে শেষমেশ যেন মেয়েটির ভবিষ্যৎ নষ্ট না হয়।' বলে তিনি সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলেন। ভাগ্যিস ফিরে তাকাননি। তাকালে দেখতে পেতেন আমার চোখে জমে থাকা অশ্রুজল।
সেদিন রাতেও রাহাদ দেড়ি করে ঘরে ফিরল। সাড়ে বারোটা নাগাদ। খাবার না খেয়েই বিছানায় চলে গেল। আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম। ততক্ষণে সে শুয়ে পড়েছে। ভাবলাম, দুপুরের ঘটনা তাকে শোনাব। ফোনে মেসেজ আসতেই সে এক লাফে উঠে বসল। স্মার্টফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে মুচকি হেসে বিছানা ছেড়ে হেঁটে হেঁটে বেরিয়ে গেল। এদিকে আমি যে এখানে বসা! এই জলজ্যান্ত মানুষটা কি তার চোখে পড়ে না? এতটাই তেতো হয়ে গেছি আমি? এতটাই?
পরদিন রাহাদের অফিসে ফোন দিলাম। রাহাদ ফোন ধরল না। একবার, দু'বার, তিনবার দেওয়ার পরও যখন ধরল না তখন তার বসের সাথে যোগাযোগ করলাম। বস ফোন ধরেই বললেন, 'ঝিনুক ভাবি, কী খবর?'
'ভাই, রাহাদকে একটু ফোনটা দিন না।'
'রাহাদ তো অফিসে নেই।'
'কোথায় সে?'
'তা তো জানি না। তবে সে এখন ছুটিতে আছে।'
'ছুটিতে! ক'দিনের ছুটি নিয়েছে?'
'এক সপ্তাহের। আপনার শরীর খারাপ বলেই তো ছুটি নিল। রাহাদ কি আপনাকে এ ব্যাপারে জানায়নি?'
'হ্যাঁ, জানিয়েছিল। আমিই ভুলে গিয়েছি। আসলে আজকাল আমার শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে। কোনো কিছু মনে রাখতে পারছি না।'
'আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন, ভাবি। সব ঠিক হয়ে যাবে।'
'আচ্ছা।' বলে ফোন ছাড়লাম। অসংখ্য প্রশ্ন ঘিরে ফেলল আমায়। রাহাদ এক সপ্তাহের ছুটি নিল কেন? ছুটিই যখন নিয়েছে, তাহলে প্রতিদিন সকালে অফিসের পোশাক পরে কোথায় যায়? সারাদিন কী করে সে?
সেদিন ছিল আমার জীবনের সবচে' কঠিন সময়। প্রতিটা মুহূর্ত চুপিসারে আর্তনাদ করেছি। অপেক্ষা করেছি। কখন আসবে সে। কখন জিজ্ঞেস করব, কেন এমন করো তুমি? কী চাও এবার বলো তো? কী করলে তুমি শুধু আমার হবে? বাইরের লোক তোমার ব্যাপারে কত কী বলে বেড়ায়, সে কি তুমি জানো? কিন্তু আমি কারোর কথা বিশ্বাস করিনি। করবও না। কেন করব বলো তো? আমি জানি, তুমি আমার। শুধুই আমার।
রাত এগারোটার দিকে রাহাদ বাসায় এল। এসেই বলল, 'খাবার দাও।'
আমি বললাম, 'খাবার নেই।'
'নেই মানে?'
'সারাদিন কোথায় থাকো তুমি?'
'ন্যাকামো হচ্ছে? অফিসে থাকি সেটা নতুন করে বলতে হবে নাকি?'
'মিথ্যে বলে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছো কেন?'
'ওঃ! সব খবর রাখো তাহলে?'
'প্রশ্ন এড়িয়ে যাবে না৷ যা জিজ্ঞেস করব, সোজা জবাব দেবে। কার সাথে দেখা করো তুমি?'
'যার সাথে ইচ্ছে করি।'
'তোমার প্রাক্তন আবার ফিরে এসেছে, তাই না?'
'হ্যাঁ, এসেছে। সে আবার ফিরে এসেছে।'
'কিন্তু আমি এসব কিছুতেই মেনে নেব না।'
'তাই নাকি? কী করবি তুই? কী করবি?'
'রাহাদ, তুই তুকারি করবে না বলে দিলাম।'
'করব। একশো বার করব। হাজার বার করব।'
'আমি কিন্তু নারী নির্যাতনের মামলা দেব।'
'বেশ, তাই দে।' বলে আমার চুল শক্ত করে ধরে এক টানে ফ্লোরে ফেলে দিলো। হাত ধরে টেনে টেনে বাইরে নিয়ে যেতে লাগল।
নিচে এনে বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল, 'ওঠ।'
'কী করছো, রাহাদ? মুসকান ঘুম থেকে উঠে গেলে একা একা ভয় পাবে।'
'উঠতে বলেছি উঠে বস।'
'না।'
'উঠবি না?'
'না।'
'তুই কি চাস, এই মাঝরাতে আমি চেঁচাই? সবার সামনে তোর গায়ে হাত তুলি?'
চোখের জল মুছে বাইকে উঠে বসলাম। মিনিট দশেক পর বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে বলল, 'যা। এবার যা কোথায় যাবি। আর কখনো যেন তোকে না দেখি।'
'কী বলছো, রাহাদ? আমি একা একটা মেয়ে। এত রাতে আমাকে ফেলে যাবে?'
সে আমার কথা শুনেনি। সাঁই করে চলে গেছে আমার চোখের সামনে থেকে। আমার চারপাশ ঘিরে নিঃস্তব্ধতা। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ পুরনো মডেলের একটি কার আমার সামনে এসে ব্রেক কষল। ড্রাইভারের সিটে বসে থাকা মাঝবয়েসী লোকটা গাড়ির কাচ নামিয়ে বিশ্রি ভঙ্গিতে বলল, 'কীরে, আজ খদ্দের জুটেনি? দেখতে শুনতে তো ভালোই। আয়, গাড়িতে ওঠ।'
লোকটার কথা অগ্রাহ্য করে রাস্তার ওপাশে চলে এলাম। লোকটা গাড়ি থেকে নেমে গলা বাড়িয়ে বলল, 'যাবি না? টাকা বাড়িয়ে দেব। ঘন্টায় হাজার টাকা। হবে?'
চলবে.. বাস্তবতাシ︎
গল্প : আলোছায়া
পর্ব : এক
লেখা S N Nayeem
আপনারা গল্প পড়ে রেস্পন্স করেন না কেনো? এই কারনেই পরবর্তী পর্বগুলা পোস্ট করার ইচ্ছে থাকেনা। যারা যারা পুরো গল্পটা পড়তে চান,,তারা সকলে অবশ্যই এই ১ম পর্বে রেসপন্স করবেন।
0 মন্তব্যসমূহ